বিপন্ন পর্যটন নগরী: কক্সবাজার সৈকতের অবৈধ স্থাপনা ভাঙতে গড়িমসি

সমকাল •

বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার। ১২০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সৈকত রক্ষায় ১৯৯৯ সালে লাবনী পয়েন্ট থেকে কলাতলী পর্যন্ত এলাকাকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন হিসেবে ঘোষণা দিয়ে গেজেট প্রকাশ করে সরকার। কিন্তু সেই গেজেটকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ওই এলাকায় একে একে গড়ে উঠেছে হোটেল-মোটেলসহ নানা স্থাপনা। এর মধ্যে রয়েছে ২০টি তিন, চার ও পাঁচতারকা মানের হোটেল। হোটেল সিগাল, সাইমন, কক্স-টুডে, প্রাসাদ প্যারাডাইস, ওশান প্যারাডাইস, অভিসার, সি-ওয়ার্ল্ড, সি-প্রিন্সেসের মতো অভিজাত হোটেলও রয়েছে সৈকতের প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকায়। এ নিয়ে পাঁচটি রিটের চূড়ান্ত রায়ে ১৯৯৯ সালের পর গড়ে ওঠা এসব হোটেলের ইজারা বাতিল করে সেগুলো গুঁড়িয়ে দিতে বলেছিলেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।

২০১৮ সালের ৯ ডিসেম্বর প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে সাত বিচারপতির আপিল বেঞ্চ এ রায় দেন। এক বছর পর ২০১৯ সালের ২৩ ডিসেম্বর রায়টি আপিল বিভাগের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়। রায়ে স্থাপনাগুলো ভেঙে ক্ষতিগ্রস্তদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিতেও বলা হয়েছে। পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর চলে গেছে প্রায় নয় মাস। এ বিষয়ে প্রশাসন এখন পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। বিষয়টি নিয়ে হতাশা ব্যক্ত করে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কক্সবাজারের সভাপতি ফজলুল কাদের চৌধুরী বলেন, প্রশাসনের সদিচ্ছার অভাবেই আপিল বিভাগের রায় কার্যকর হচ্ছে না। অবৈধ স্থাপনা ভাঙতে প্রশাসন গড়িমসি করছে। অবশ্য কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক ও সৈকত ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি কামাল হোসেন বলেছেন, রায় কার্যকরে তাদের সদিচ্ছার অভাব নেই। রায়ে ক্ষতিপূরণের বিষয় যুক্ত থাকায় তা কার্যকর করতে সময় লাগছে। কীভাবে এই ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা হবে, তা নিয়ে আলোচনা চলছে।

সৈকতের ক্ষুদ্র ব্যবসা প্রভাবশালীদের দখলে :কক্সবাজার সৈকত ব্যবস্থাপনা কমিটির একজন সদস্য নইমুল হক চৌধুরী টুটুল। জেলা জাসদের সভাপতিও তিনি। সৈকতের সুগন্ধা পয়েন্টে তার নামে বরাদ্দ রয়েছে খাবারের দোকান। সৈকতে ভ্রাম্যমাণ হকারদের জন্য এসব অস্থায়ী দোকান বরাদ্দের কথা থাকলেও ব্যক্তিগত প্রভাব খাটিয়ে জেলা প্রশাসনের পর্যটন ও প্রটোকল শাখা থেকে এ দোকান বরাদ্দ নিয়েছেন তিনি।

নইমুল হক চৌধুরীই শুধু নন, সৈকত ব্যবস্থাপনা কমিটির আরও কয়েকজন সদস্য নিজের, স্বজনের বা অনুগত লোকজনের নামে অস্থায়ী দোকান, কিটকট (সৈকতপাড়ে বড় ছাতা ও বসার স্থান), জেট-স্কি বরাদ্দ নিয়ে ব্যবসা করছেন। এ তালিকায় রয়েছেন স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে সাবেক এক প্রভাবশালী আমলা, সচ্ছল মুক্তিযোদ্ধা ও সাংবাদিকও।

সৈকতের সুগন্ধা পয়েন্টে সাবেক ওই আমলার ভাই হিসেবে পরিচিত জহির আলমের রয়েছে ছয়টি দোকান। সৈকতে কিটকটও বরাদ্দ নিয়েছেন তিনি। এসব দোকান ও কিটকটের দেখভাল করেন সৈকতের স্টুডিও মালিক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক কাঞ্চন আইচ। এ বিষয়ে কাঞ্চন আইচ বলেন, ‘জহির আলমের নামে সেখানে ছয়টি দোকান রয়েছে। সিগাল পয়েন্টে রয়েছে ৩০টি কিটকিট। এর বাইরে কিছু নেই। সেগুলোর দেখাশোনা করি আমি।’ এ বিষয়ে জহির আলমের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

সুগন্ধা পয়েন্ট হয়ে সাগরে নামার পথে ডান পাশের মার্কেটের বড় একটি অংশ ‘মুক্তিযোদ্ধা’ মার্কেট নামে পরিচিত। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওই অংশে ৪০টির মতো দোকান রয়েছে। সৈকতের ভ্রাম্যমাণ ব্যবসায়ীরা জানান, ওই মার্কেটের দেখভাল করেন লালু নামে এক ব্যক্তি। লালু ও তার ছেলে বকুলের নামে এ মার্কেটে চারটি দোকান বরাদ্দ রয়েছে। পিতা-পুত্র সৈকতে ২০টি কিটকটও বরাদ্দ পেয়েছেন। ভাড়া নিয়ে চালান আরও ২৫টি। লালু স্থানীয় ব্যবসায়ী সমিতির একাংশের সভাপতি। সুগন্ধা পয়েন্টে কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার নামে বরাদ্দকৃত দোকান পরিচালনা করেন লালু। তার মাধ্যমে মাসে দোকান ভাড়ার টাকা চলে যায় প্রভাবশালীদের পকেটে।
মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার মো. শাহজাহান বলেন, ‘সুগন্ধা পয়েন্টে ৬-৭ জন মুক্তিযোদ্ধা বা তাদের সন্তানদের নামে দোকান বরাদ্দ রয়েছে। এগুলো ঠিক দোকানও নয়, চৌকি বলা যায়। অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধারা সেই দোকান থেকে অল্প কিছু টাকা পান।’
মুক্তিযোদ্ধা মার্কেটের পরের অংশ ‘জালাল মার্কেট’ হিসেবে পরিচিত। সেখানে রয়েছে ১০৫টি দোকান। ব্যবসায়ী সমিতির একাংশের সভাপতি জালাল ওই মার্কেটের নিয়ন্ত্রক। জেলা আওয়ামী লীগের একজন শীর্ষ নেতা ও একজন পৌর কাউন্সিলর তাকে ‘শেল্টার’ দেন। অভিযোগ রয়েছে, সেখানে প্রতিটি দোকান বিক্রি হয়েছে চার থেকে ছয় লাখ টাকায়।

এ মার্কেটের বিপরীত দিকে অর্থাৎ সৈকতে নামার পথে বাঁ পাশে অনেক দিন আগের গড়ে তোলা মার্কেটের একাংশ নিয়ন্ত্রণ করেন ওই অংশের সভাপতি মো. রুবেল। অন্য অংশ নিয়ন্ত্রণ করেন জাকির নামে এক ব্যক্তি। অভিযোগ রয়েছে, সেখানেও অনেক দোকান হাতবদল করে বিক্রি হয়েছে দুই থেকে ছয় লাখ টাকায়।
সৈকতের লাবনী পয়েন্টে ‘ছাতা মার্কেট’ নামে শতাধিক দোকান নির্মাণ করে ভাগবাটোয়ারা করে নিয়েছেন প্রভাবশালীরা। অনেকে এই দোকান বিক্রি করে বিপুল অঙ্কের টাক